মোরসালীন জেবীন তুরিন
বর্তমান যুগে আমরা সবাই ব্যস্ত, এই ব্যস্ততা ও যান্ত্রিকতার কারণে আমাদের জীবনযাত্রা কিছুটা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে, সাথে রয়েছে অসচেতন খাদ্যাভ্যাস। আমরা সবাই মানসিক পরিশ্রম করছি কিন্তু এর সাথে সাথে আমরা কায়িক পরিশ্রম করছি না। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ও অসচেতন খাদ্যাভ্যাস চালিয়ে যাওয়ার ফলে বর্তমানে আমরা এমন কিছু রোগে আক্রান্ত হচ্ছি, যা একটু সচেতন হলেই আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। আমাদের অসচেতনতার কারণে এই ধরনের রোগ আমাদের মৃত্যু ঝুঁকিতেও ফেলে দেয়। এই অবস্থা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। সুস্থসবল জাতি গঠনের উদ্দেশ্যে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন নিয়েও সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং জানতে হবে।
সিডেন্টারি লাইফ স্টাইল (Sedentar Life Style) হলো এমন ধরনের জীবনযাপনকে বোঝায় যেখানে ব্যক্তি নিয়মিত প্রয়োজনীয় শারীরিক পরিশ্রম করে না। বলা হয়ে থাকে যে, একজন প্রাপ্তবয়স্কের ১৫০ মিনিট মাঝারি ব্যায়াম অথবা ৭৫ মিনিট ভারী/কঠিন ব্যায়াম সপ্তাহে করা উচিত। স্বাস্থ্যবিদরা বলে থাকেন যে, দিনে ১০ হাজার পদক্ষেপ অথবা ৫ মাইল হাঁটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো যা মানুষকে অসুস্থতার ঝুঁকি থেকে রক্ষা করে। WHO এর তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ৬০-৮৫% লোক পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম করে না। বিশ্বের মৃত্যু ঝুঁকির মধ্যে ৪র্থ কারণ হলো পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম না করা।
সিডেন্টারি লাইফ স্টাইল ঊ-এর ঝুঁকিসমূহ হচ্ছে ডায়াবেটিস, অবেসিটি, হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, উচ্চকোলেস্টেরল, ফ্যাটিলিভার, ক্যান্সার (কোলন, ব্রেস্ট, জরায়ু) প্রভৃতি।
ডায়াবেটিস
যখন শরীর শক্তির জন্য গ্লুকোজ ব্যবহার করতে পারে না, অপর্যাপ্ত ইনসুলিন উৎপাদন, ডায়াবেটিস বয়স জিন ফ্যাক্টর স্থূলতা অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অপুষ্টি দুশ্চিন্তা ইত্যাদির কারণে ডায়াবেটিস হয়ে থাকে।
এর ফলে অতিরিক্ত ঘুম, অতিরিক্ত পিপাসা, বেশি বেশি ক্ষুধা পাওয়া, চোখে ঝাপসা দেখা, পা জ্বালাপোড়া করা, শরীর দুর্বলতা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়।
প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের উপায়
প্রাথমিক প্রতিরোধের মধ্যে আমাদের স্বাভাবিক ওজন বজায় রাখতে হবে, সুষম খাবার গ্রহণ করতে হবে, স্বাস্থ্যকর অভ্যাস করতে হবে, নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে, তামাক ও দুশ্চিন্তা পরিহার করতে হবে। দ্বিতীয় ধাপের প্রতিরোধের মধ্যে রোগীকে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। প্রয়োজনীয় ওষুধ/ ইনসুলিন গ্রহণ করতে হবে, ত্বকের (হাত, পায়ের) যত্ন নিতে হবে।
স্থুলতা
যখন শরীরে অস্বাভাবিক বা অতিরিক্ত ফ্যাট জমা হয়। যা স্বাস্থ্যর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়। এটি এক প্রকার অপুষ্টি যা শরীরকে অসুস্থ করে ফেলে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে ৩০০ মিলিয়নের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ স্থূলতার স্বীকার, আর স্থূলতা হলো মৃত্যু ঝুঁকি দমন করা যায় এমন রোগের মধ্যে দ্বিতীয়। কারণ এই স্থূলতার কারণে উচ্চরক্তচাপ, নিদ্রাহীনতা, বাত, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং সামাজিক সমস্যাও হয়।
স্থ‚লতার পরিমাপ করা যায় বিএমআইয়ের মাধ্যমে যা ওজন এবং উচ্চতার অনুপাত। প্রাপ্তবয়স্কদের বিএমআই সাধারণত ১৮ থেকে ২৫ থাকা উচিত। বিএমআই ২৫ এর উপরে গেলে স্থ‚লতা বলা যায়।
কোমরের পরিধি পরিমাপের মাধ্যমেও স্থ‚লতা বোঝা যায়। পুরুষদের কোমর ৪০ ইঞ্চি ও মহিলাদের কোমর ৩৫ ইঞ্চির বেশি হলে স্থ‚লতা ধরা হয়। স্থ‚লতার কারণগুলোর মধ্যে শারীরিক পরিশ্রম না করা, সুষম খাবার না খাওয়া, বিভিন্ন ওষুধ গ্রহণ এবং বংশগতকারণও থাকতে পারে। সেজন্য আমরা ফ্যাটজাতীয় খাবার কম গ্রহণ করব। বেশি ফল ও শাকসবজি খাবো, কাঁচা লবণ খাবো না, নিয়মিত ব্যায়াম করব এবং দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকব।
হৃদরোগ
হৃৎপিণ্ড যখন রক্ত সরবরাহ করতে পারে না, রক্তশিরায় ব্লকেজ হয় হয় তখন হৃদরোগ হয় । এ ছাড়া বয়স, লিঙ্গ, বংশগত কারণে, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস ধূমপান ইত্যাদির কারণে হৃদরোগের ঝুঁকি থাকতে পারে।
প্রতিরোধের উপায়
হৃদরোগের ঝুঁকি এড়াতে আমাদের ধূমপান পরিহার করতে হবে, ওজন, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে, দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপন করতে হবে। নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন, নাইট্রেটের ব্যবহার প্রয়োজনে সার্জারি করতে হবে।
উচ্চরক্তচাপ
যখন রক্ত শিরায় রক্তচাপ স্বাভাবিকের থেকে সবসময় বেশি থাকে তখন সেটা উচ্চরক্তচাপ ধরা হয়। সাধারণত বংশগতকারণে, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, স্থ‚লতা, বয়স, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কারণে উচ্চরক্তচাপ হতে পারে। সাধারণত ২০ বছরের ব্যক্তির ক্ষেত্রে যদি ১৪০/৯০ রক্তচাপ হয় তবে তা উচ্চরক্তচাপ। ৫০ বছরের ব্যক্তির ক্ষেত্রে যদি ১৬০/৯৪ তবে তার ক্ষেত্রে তা উচ্চরক্তচাপ। মাথাব্যথা বুক ধরফর, ক্লান্তি, চোখে ঝাপসা দেখা ইত্যাদি উচ্চরক্তচাপের লক্ষণ।
প্রতিরোধের উপায়
প্রথমে নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করতে হবে, কাঁচা লবণ পরিহার করতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে, নিজের যত্ন নিতে হবে। প্রয়োজনে ওষুধ নিয়মিত সেবন করতে হবে।
ফ্যাটিলিভার
লিভারে যখন অনেক ফ্যাট জমা হয়। তখন সেটা ফ্যাটিলিভার, চর্বি জাতীয় খাবার বেশি গ্রহণের ফলে ফ্যাটিলিভার হয়। ফ্যাটিলিভার থেকে বাঁচতে হলে সঠিক ওজন বজায় রাখতে হবে। সুষম খাবার খেতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে, তামাক জাতীয় খাবার গ্রহণে বিরত থাকতে হবে।
স্ট্রোক
মস্তিষ্কে যখন রক্ত সরবরাহ কমে যায়, মস্তিষ্কের কোষগুলো মারা যায় তখন তাকে স্ট্রোক বলা যায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে সকল মৃত্যুর কারণে মধ্য ৬.৭২% মানুষ স্ট্রোক করেই মারা যায়। লিঙ্গ, বয়স, বংশগত কারণে স্ট্রোক হতে পারে, স্ট্রোকের লক্ষণসমূহের মধ্য প্যারালাইজড হয়ে যাওয়া, কথা বলায় অস্পষ্টতা ও অসংলগ্নতা, মুখ বাঁকা ইত্যাদি হতে পারে।
প্রতিরোধের উপায়
স্ট্রোক হতে মুক্তি পেতে হলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে, ধূমপান পরিহার করতে হবে। ওজন ঠিক রাখতে হবে, শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে।
ক্যান্সার
কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হলো টিউমার বা ক্যান্সার। সিডেন্টারি লাইফ স্টাইল এর জন্য কোলন ক্যান্সার, ব্রেস্ট ক্যান্সার, জরায়ু ক্যান্সার হতে পারে। তাই আমাদের ক্যান্সার বাঁচার জন্য তামাক পরিহার, সুষমখাবার গ্রহণ করা, সঠিক ওজন বজায় রাখা, নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, নিয়মিত মেডিক্যাল চেকআপ, প্রতিষেধক গ্রহণ করা উচিত।
নগর জীবনযাপনের কারণে আমরা শারীরিকভাবে নিষ্ক্রিয় (Physically inactive) হয়ে পড়ছি তবে সুস্থ থাকতে হলে আমাদের ইচ্ছে করেই পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের দেশে প্রচুর খাবার আছে কিন্তু পুষ্টিজ্ঞানের অভাবে আমরা অপুষ্ট। আমাদের ৪০০ গ্রাম ফল শাকসবজি খেতে হবে। ভিটামিন সি জাতীয় খাবার নিয়মিত খেতে হবে। সকাল দশটা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত রোদ থেকে ভিটামিন ডি গ্রহণ করতে হবে। আমাদের জীবনধারা (Life style) এর পরিবর্তন নিজেকে দিয়ে, নিজের পরিবারকে দিয়ে শুরু করতে হবে, নিরাপদ খাবার খেতে হবে এবং নিরাপদ খাবার উৎপাদনে নজর রাখতে হবে। সর্বোপরি আমাদের মনে রাখতে হবে যে “স্বাস্থ্যই সম্পদ ’’ য়
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বারটান, আঞ্চলিক কার্যালয় সিরাজগঞ্জ, মোবাইল : ০১৭২৩-৬৭২১৯২, ই-মেইল: rinbsmrau@gmail.com